ইসলামে দাসীদের আওরাহ বা পর্দার বিধান কি?

ইসলামে দাসীদের আওরাহ বা পর্দার বিধান কি? 


লিখেছেনঃ সাজ্জাতুল মাওলা শান্ত। 

এই বিষয়ে মুশফিক মিনার ভাইয়ের এই আলোচনাটি দেখতে পারেন। আই আর্টিকেলের কিছু রেফারেন্স মিনার ভাইয়ের আলোচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোচনা লিংকঃ 

উমর (রাঃ) ঘোমটা দেওয়া একজন দাসীকে দেখতে পেয়ে তাকে প্রহার করলেন। এবং বললেন "স্বাধীন নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করোনা।" 
রেফারেন্সঃ মুসান্নাফ ইবন আবি শায়বা; ৬/২৩৬ 

উক্ত হাদিসকে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করে মুক্তমণা নাস্তিকরা অভিযোগ করে যে ইসলামে দাসীদের পর্দার বিধান আর স্বাধীন নারীর পর্দার বিধান এক নয়। তাদের অভিযোগ হলো ইসলামে দাসীদের ক্ষেত্রে পর্দার বিধান হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ডেকে রাখা। মুক্তমণা নাস্তিকরা যে অভিযোগটি করে থাকে তা সত্য নয়। অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসদের মতে এই হাদিস সহীহ নয়। বরং এই হাদিসের বিপক্ষে কুরআন ও সহীহ হাদিসে অনেক আয়াত-হাদিস রয়েছে। 

ইবনে কাত্তান (রা.) এই হাদিস সম্পর্কে বলেছেন,
"এটি তার [উমার (রাঃ)] থেকে বর্ণিত হাদিস নেই। এবং এটি সহীহ বর্ণনা নয়। আর এই বর্ণনাতে সেই দাসীর জন্য স্বাধীন নারীর মতো পোশাক পরার ব্যাপারে নিষেধ করার থেকে বেশি কিছু নেই।" 
রেফারেন্সঃ আহকামুন নযর-ইবনু কাত্তান; ১/২৩০ 
 
দাস প্রথার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইসলাম ছাড়া বাকি সকল ধর্মে ও মতবাদে দাস-দাসীদের সাথে নির্মম আচরণ ও পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। এমনকি দাসীদের মানুষ হিসেবেও গণ্য করা হতোনা। ইসলাম একমাত্র ধর্ম যেখানে দাস-দাসীদের সাথে ভালো আচরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে এবং অন্য সকল স্বাধীন মানুষের মতো সুযোগ সুবিধা রয়েছে। 

আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ 
রাসুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের খুশি করে তাদেরকে তোমরা যা খাও তাই খেতে দাও। এবং তোমরা যা পরিধান করো তাই পরতে দাও। আর যেসব দাস তোমাদের খুশি করেনা তাদের বিক্রি করো। তোমরা আল্লাহর সৃষ্টিজীবকে শাস্তি দিও না। 
রেফারেন্সঃ সুনান আবু দাউদ; হাদিস নং-৫১৬১ 
এই হাদিসে স্পষ্ট বলা হচ্ছে স্বাধীন ব্যক্তি যা খাবে, যা পরবে তাই দাস-দাসীদের খাওয়াতে হবে এবং পরাতে হবে।  

আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা বলেন; 
হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মু'মিন নারীদেরকে বলঃ তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যাক্ত করা হবেনা। আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু। 
রেফারেন্সঃ সূরা আহযাব; ৩৩ঃ৫৯ 
তাফসিরে ফাতহুল মাজিদে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছে, স্বাধীন নারীদের অনুরুপ দাসীদেরকেও সতীত্ব রক্ষা করা ফরয করে দিয়েছে। রেফারেন্সঃ   

স্বাধীন নারী ও দাসীদের পর্দার বিধান কি হবে এটা এমন কোনো বিষয় নয় যে এই বিষয়ে সমস্ত আলেমগন সর্বস্মতিক্রেমে একমত। বরং এই বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতপার্থ্যক্য রয়েছে। অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য আলেমগণের মতে পর্দার ক্ষেত্রে স্বাধীন নারী ও দাসীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং যারা মনে করে স্বাধীন নারী ও দাসীদের পর্দার বিধান আলাদা তাদের মতের পক্ষে কোনো সহীহ প্রমাণ নেই। 

ইমাম আল হাফিজ ইবনুল কাত্তান আল ফাসি (র.) বলেছেন,
সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা সকল নারীর জন্য। স্বাধীন হোক বা দাসী, সমস্ত সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করা পুরুষ বা মহিলা,নন-মাহরাম,আত্মীয় বা শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য। রেফারেন্সঃ 

শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানির (র.) এর মতে, 
যেসব আলেমগণ স্বাধীন নারী ও দাসীদের পর্দার বিধান আলাদা মত দিয়েছে তাদের কারো মতামত সহীহ নয়। আশ্চার্যের বিষয় যে কোনো কোনো মুফাসসির যঈফ হাদিস দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। যার ফলে তাদের মতামত হলো (সূরা আহযাবের-৩৩ঃ৫৯) আয়াতে মু'মিনা নারী বলে স্বাধীন নারীদেরকে দাসীদের থেকে আলাদা করা হয়েছে। এবং তারা উল্লেখ করেছে যে দাসীদের পর্দার বিধান পুরুষের ন্যায় নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত। কিন্তু এই ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে কোনো দলিল নেই। রেফারেন্সঃ 

ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) এর মতে, 
প্রতিষ্ঠিত অভিমত হলো দাসীর আওরাহ স্বাধীনা নারীর আওরাহর ন্যায়। ঠিক যেমনি একজন পুরুষ দাসের আওরাহ স্বাধীন পুরুষের আওরাহর ন্যায়। তবে দায়িত্ব ও কাজকর্মের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু প্রদর্শন করতে পারবে। তার বুক ও পিঠের বিধান হলো, সেগুলো থাকবে প্রতিষ্ঠিত অভিমত অনুসারে। 
রেফারেন্সঃ শারহুল উমদাহ - ইমাম ইবন তাইমিয়া ২/২৭৫।  

কাতার ভিত্তিক জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ একটি ফতোয়ার ওয়েভসাইটে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ফতোয়া হেডিং ও ফতোয়া নং 
"No authentic evidence that slave women used to walk around bare-breasted
 Fatwa No: 355954

এই আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়ছে, দাসী নারীদের বুক বা স্তন খোলা রেখে চলাফেরা করার পক্ষে বিশুদ্ধ কোনো প্রমাণ নেই। 
ইমাম ইবন তাইমিয়া হতে বর্ণিত, আলী (রা.) বলেন, "দাসী নারীরা সালাতের সময় যে ধরণের পোশাক পরিধান করে বাহিরে বের হওয়ার সময়ও সে ধরণের পোশাক পরিধান করবে।" এবং এটা ভালো করেই জানা যে, দাসী নারীরা বুক ও স্তন খোলা রেখে বাহিরে যেত না। [Sharh Al-‘Umdah]

ইমাম মালিক (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোনো দাসী নারী যদি বুক খোলা রেখে বাহিরে যায়, আপনি কি তাকে ঘৃণা করবেন ? তিনি বললেন "হ্যা। এবং এটা করলে আমি তাকে শাস্তি দেবো।"  
রেফারেন্সঃ মাওয়াহিব আল জালিল, মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আল মাগরিবি ১/১০৫ 

 দাস দাসীকে প্রহার করলে তাকে মুক্ত করে দেওয়া অপরিহার্যঃ                                     
মুইয়াবিন বিন সুওইয়াদ হতে বর্ণিতঃ 
আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘার করি, অতঃপর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন; সে তোমার প্রতি যা করেছে তুমিও তেমন করো। সে(ক্রীতদাস) আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসী ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো, এই খবর রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে পৌঁছাল এবং তিনি বললেন; তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন; সে ছাড়া আমাদের আর কোনো সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন; তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও তাকে মুক্ত করে দাও। রেফারেন্সঃ সুনান আবু দাউদ; হাদিস নং-৫১৬৭ ও https://sunnah.com/urn/240810 
                                                                                                                

আবূ মাস’ঊদ আল-আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একদা আমার এক ক্রীতদাসকে প্রহার করছিলাম। এ সময় আমার পিছন হতে একটি শব্দ শুনতে পেলাম, হে আবূ মা’সঊদ! জেনে রাখো, আল্লাহ তোমার উপর এর চেয়ে বেশী ক্ষমতাবান যতটুকু তুমি তার উপর ক্ষমতাবান। আমি পিছন হতে তার এরূপ ডাক দু’বার শুনতে পেলাম। আমি পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসুল! সে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য স্বাধীন (আমি তাকে মুক্ত করে দিলাম)। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি যদি তাকে মুক্ত না করে দিতে তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে গ্রাস করতো। 

রেফারেন্সঃ সুনানে আবু দাঊদ; হাদিস নং ৫১৫৯ 

হিলাল ইবনু ইয়াসাফ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমরা সুয়াইদ ইবনু মুক্বাররিন (রাঃ) এর বাড়ীতে থাকতাম। আমাদের সঙ্গে একজন মেজাজী বৃদ্ধ ছিলেন এবং তার সঙ্গে একটি দাসী ছিল। তিনি তার চেহারায় চড় মারলেন। এ কারণে, সুয়াইদ (রাঃ) এতোটা উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, আমরা তাকে এমন উত্তেজিত হতে আর দেখিনি। তিনি বললেন, একে আযাদ করা ব্যতীত তোমার জন্য অন্য কোন পথ নেই। তুমি দেখছো যে, আমাদের মুক্বাররিনের সাতটি সন্তান। আমাদের মাত্র একজন খাদেম ছিল। আমাদের কনিষ্ঠজন তার মুখে চড় মেরেছিল বিধায় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে তাকে আযাদ করার নির্দেশ দিলেন।

রেফারেন্সঃ সুনানে আবু দাঊদ; হাদিস নং- ৫১৬৬ 

ইসলামে দাসীদের প্রহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ একটি কাজ ও প্রহার করলে তাকে মুক্ত করে দিতে হবে সুতরাং উমর (রা:) দাসীদের প্রহার করার প্রশ্নই আসেনা।  


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url