আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে কুরআনের যুক্তি।
আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে কুরআনের যুক্তি।
লিখেছেনঃ সাজ্জাতুল মাওলা শান্ত।
সৃষ্টিকর্তা আছে নাকি নেই? এই বিতর্ক নতুন কিছু নয়। প্রাচিনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক হয়ে আসছে। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে কুরআনের যুক্তিগুলো আলোচনার আগে আমরা সৃষ্টিকর্তা নিয়ে কেন আমরা আলোচনা করি সেই বিষয়ে জেনে নিবো। এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে ভিবিন্ন মতবাদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে ধারণা নিবো।
সৃর্ষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্কের কারণ আমাদের অস্তিত্ব। এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব। আমাদের অস্তিত্বের জন্যই আমরা সৃর্ষ্টিকর্তা নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করতে বাধ্য। যার ফলে যুগ যুগ ধরে মানুষ সৃর্ষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করে আসছে।
কিভাবে আমাদের অস্তিত্ব ও মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণে আমারা সৃষ্টিকর্তা নিয়ে আলোচনা করি তার একটা ছোট ব্যক্ষ্যা দেওয়া যাক। পাশ্চ্যাতের অধুনিক দর্শনের জনক রেনে ডেকার্ড একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে যার নাম Methodic doubt and reversal doubt. এই পদ্ধতিতে সব কিছুকে সন্দেহ করা হয়।
রেনে ডেকার্ড এর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, "Cogito ergo sum". ( "I think, therefor i am."
ডেকার্ড সবকিছুকেই সন্দেহ করতো। তার নিজের অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নিয়েও সে সন্দেহ করতো। কিন্তু ডেকার্ড দেখতে পাই যে জগতের সব কিছুর উপর সন্দেহ করলেও নিজের অস্তিত্বের উপর সন্দেহ করা সম্ভব না। "আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি। কেননা আমি যদি নাই থাকি তাহলে সন্দেহ বা চিন্তা করে কে? আমার চিন্তা শক্তি আছে,তাতেই আমার অস্তিত্বের প্রমাণ। চিন্তা বা সন্দেহ যদি ক্রিয়া হয় তাহলে সেই ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে আমি আছি। কেননা, There is no action without reaction. তাহলে আমি যদি থাকি আমি কোথায় আছি? আমি এই জগতে আছি। জগত কোথায় থেকে এলো? জগতের অস্তিত্ব কি ? এই জগত যে সৃষ্টি হয়েছে তা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা!যদি Big bang theory-র উপর ভিত্তি করে আমরা যুক্তি দাঁড় করায় যে মহাবিশ্ব Big bang'থেকে সৃষ্টি, তাহলে এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ওয়েভসাইটে লিখেছে,
The Conclusion of this lecture is that the universe has not existed forever. Rather, the universe, and time itself, had a beginning in the big bang, about 15 billion years ago. - The Beginning of Time, Stephen Hawking. রেফারেন্সঃ
তাহলে জগতের সৃষ্টিকর্তা কে ? এ ধরণের প্রশ্নগুলোই আমাদের সৃষ্টিকর্তা নিয়ে আলোচনা,সমালোচনা করতে বাধ্য করে। ফিলোসফির ভাষায় এগুলোকে বলা হয় "Existential question."
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মতবাদ
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মানুষের মনে ভিবিন্ন ধরণের মতবাদ রয়েছে। যেমনঃ
১. একেশ্বরবাদ (Monotheism): এই মতবাদ অনুসারে সৃষ্টিকর্তা একজন। এবং তিনি এই মহাবিশ্ব পরিচালনা করে।
২. বহু-ঈশ্বরবাদ (Polytheism): এই মতবাদে মনে করা হয়, সৃষ্টিকর্তা একাধিক। এবং একাধিক স্রষ্টা এই মহাবিশ্ব পরিচালনা করে।
৩. আজ্ঞেয়বাদ (Agnosticism): এই মতবাদ অনুসারে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে জানা যায়না।
৪. অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ (Deism): এই মতবাদ অনুসারে, সৃষ্টিকর্তা এই জগত সৃষ্টি করেছে। এবং এই জগত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সৃষ্টি করলেন। এর পর সৃষ্টিকর্তা জগতের বাহিরে অবস্থান করেন।
৫.সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism): এই মতবাদ অনুসারে, সৃষ্টিকর্তা হলো এক অন্তর্ব্যাপী সত্তা। সৃষ্টিকর্তার সাথে জগতের সম্পর্ক হলো অন্তর্ব্যাপী সম্পর্ক। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাই সব এবং সবই সৃষ্টিকর্তা।
৬. সর্বধরেঈশ্বরবাদ (Panentheism): এই মতবাদ ঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। এই মতবাদ অনুসারে ঈশ্বর জীব ও জগতের সম্পূর্ণ বাহিরে।
৭. নাস্তিক্যবাদ (Atheism): এই মতবাদ অনুসারে সৃষ্টিকর্তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই জগত কেবল দূর্ঘটনা থেকে সৃষ্টি।
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কুরআনের যুক্তি।
তারা কি স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা ? সূরা আত্ব তূর; ৫২ঃ৩৬
নাকি তারা আসমান যমীন সৃষ্টি করছে ? আসলে তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী নয়।
সূরা আত্ব তূর; ৫২ঃ৩৭
কুরআনের এই যুক্তিগুলোতে মানুষকে বুঝানো হয়েছে। তবে মানুষ ছাড়া অন্য যেকোনো সৃষ্ট বিষয়ে আমরা এগুলো প্রয়োগ করতে পারবো। কেননা, এখানে খুলিকু (خُلِقُو) শব্দের অর্থ হচ্ছে সৃষ্ট।
কুরআনের এই যুক্তিগুলোকে আরেকটু গভীরভাবে ব্যাক্ষা করা যাক।
* তারা কি স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে? [ ইউনিভার্স এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছে। ]
* নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা [ ইউনিভার্স নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। ]
* নাকি তারা আসমান যমীন সৃষ্টি করছে ? [ ইউনিভার্স অন্য কোনো সৃষ্ট বস্তু থেকে সৃষ্টি। ]
* আসলে তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী নয়। [ চিরন্তন সত্তা থেকে সৃষ্ট। ]
ইউনিভার্স এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছে ?
সৃষ্টি মানে কোনো কিছু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসা। মানে একটা সময় যার কোনো অস্তিত্ব ছিলোনা কিন্তু পরবর্তিতে অস্তিত্বে আসে। সৃষ্টি কাকে বলে এটা বুঝতে পারলে আপনি বুঝবেন কোনো কিছু নিজে নিজে সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। কেননা একটা বস্তু একই সময় অস্তিত্বশীল, আবার অস্তিত্বশীল না! এটা কিছুতেই সম্ভব না। কোনো কিছু আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে এই কথার মানে হলো, অস্তিত্বে আসার আগেই সেটা অস্তিত্বে ছিলো ! এটা কিছুতেই সম্ভব না।
উদাহারণ স্বরূপ, 'ক' নামক ব্যক্তি জন্ম নেওয়ার আগেই কি নিজেকে সৃষ্টি করতে পারবে ?
ইউনিভার্স অন্য কোনো সৃষ্ট বস্তু থেকে সৃষ্টি?
ইউনিভার্স যদি অন্য কোনো সৃষ্ট বস্তু বা সত্তা থেকে সৃষ্টি হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন আসবে "সেই সৃষ্ট সত্তাকে কে সৃষ্টি করলো ?"
যদি বলা হয় সেই সত্তাকে অন্য আরেক সত্তা সৃষ্টি করছে। আবারো প্রশ্ন আসবে "অন্য আরেক সত্তাকে কে সৃষ্টি করলো?"
এভাবে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন চলতে থাকলে "অনবস্থা দোষ"(Infinie regress) দেখা যাবে।
এছাড়া কালাম কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট অনুসারে প্রত্যেক কার্যের কারণ আছে। অর্থাৎ অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসতে হলে তার পিছনে অবশ্যই একটা কারণ থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে সৃষ্ট হওয়া সবকিছুর যদি কারণ থাকে তাহলে কারণেরও কারণ আছে। তবে এই কার্য থেকে কারণ সম্পর্ক হিসেব করতে করতে আমাদের চিন্তাধারা ক্রমান্বয়ে পিছনের দিকে যেতে পারেনা। তাহলে "অনবস্থা দোষ"(Infinie regress) দেখা দিবে।
যদি "অনবস্থা দোষ"(Infinie regress) দেখা যায় তাহলে কখনোই বর্তমানে আসা সম্ভব না।
উদাহারণ স্বরূপ, এই ইউনিভার্স যদি "X" হয়, আর একে সৃষ্টি করে থাকে "X1", আবার "X1" কে যদি সৃষ্টি করে "X2" আর এইভাবে যদি অনন্তকাল চলতে থাকে তাহলে "X" কখনোই অস্তিত্বে আসতে পারবে ? না কখনোই পারবেনা !
কেননা "X" অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে "X1"এর উপর, আবার "X1" অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে "X2"এর উপর এবং এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকে। "X" অস্তিত্বে আসার জন্য নির্ভর করে অনাদিকাল ধরে চলা সৃষ্ট কিছুর উপর তাহলে বর্তমানে আসা সম্ভব না।
সুতরাং, ইউনিভার্স সৃষ্টির কারণ যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার জন্য অসীম সংখ্যক কারণের প্রয়োজন নেই। বরং শুরুতে এমন একজন স্রষ্টা আছে যার পিছনে আর কোনো স্রষ্টা নেই।
Low of parsimony ( মিতব্যয়িতা নিয়ম ) অনুসারে, একই জিনিসের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। তাহলে এই ইউনিভার্সের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। এবং সেই কারণই হলো সৃষ্টিকর্তা।
চিরন্তন সত্তা থেকে সৃষ্ট।
এই মহাবিশ্ব নিজে নিজে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব না, আবার অন্য কোনো সৃষ্ট বস্তু থেকেও সৃষ্টি সম্ভব না। তাহলে এর বিকল্প কি ?
বিকল্প হচ্ছে এই মহাবিশ্ব চিরন্তন কোনো স্রষ্টা থেকে সৃষ্ট। অন্যভাবে বলতে গেলে এই ইউনিভার্স কোনো কারণহীন কারন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। মোট কথা কিছু একটাকে সবসময় অস্তিত্ববান হতে হবে। সেটা হয় সৃষ্টিকর্তা বা ইউনিভার্স। কিন্তু ইউনিভার্সের যেহেতু শুরু আছে,ইউনিভার্স সসীম বা ফাইনেট, (উপরে রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে ) তাই ইউনিভার্স আদি কারণ হতে পারেনা। কোনো প্রকার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ,রেফারেন্স ছাড়াও এটা প্রমান করা সম্ভব যে ইউনিভার্স সসীম বা ফাইনেট। এই বিষয়ে নিন্মে আলোচনা করা হবে।
তাহলে যিনি সব সময় অস্তিত্ববান তিনি সৃষ্টিকর্তা বা মহান আল্লাহ।
অধ্যাপক আন্থনি ফ্লিউইয়ের দেয়ার ইজ গড বইয়ের পরিশিষ্টে অধ্যাপক আব্রাহাম ভার্গেস জোরালভাবে বলেছেন,
" আস্তিক-নাস্তিক একটি বিষয়ে একমত হতে পারে; যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তা হলে এর আগে অবশ্যই এমন কিছু থাকতে হবে যা সব সময় অস্তিত্বশীল। চিরকালীন অস্তিত্ববান এই সত্তা কিভাবে এসেছে? এর উত্তর হলো, এটা কোনোভাবেই আসেনি। এটা সব সময় অস্তিত্ববান। এখন পছন্দ আপনার; হয় সৃষ্টিকর্তা নয় মহাজগৎ। কিছু একটা সব সময়ই ছিলো।
রেফারেন্সঃ ফ্লিউ, এ. (২০০৭)। দেয়ার ইজ গড; হাউ দা ওয়ার্ল্ড'স মস্ট মটরিয়াস এথিস্ট চেইনজড হিজ মাইন্ড। নিউ ইয়ার্ক; হার্পারওয়ান। ২০০৭। পৃষ্টা ১৬৫। [রেফারেন্সটি হামজা জর্জিসের "দা ডিবাইন রিয়ালিটি" বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
অসীম মহাবিশ্ব ?
আমাদের সকলেরই জানার কথা যে ইউনিভার্স অসীম হতে পারেনা। আর না জেনে থাকলেও এই আর্টিকেল উপরে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছে যে মহাবিশ্ব অসীম নয় তা থেকে নিশ্চয় বুঝার কথা। তবুও আমরা একটু বিস্তারিত আলোচনা করবো যে, কেন ইউনিভার্স অসীম হতে পারেনা।
এই ব্যাপারে কোনো নাস্তিক-আস্তিক কারোই সংশয় থাকার কতা না যে, মহাবিশ্বের শুরু আছে বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। অস্তিত্বশীল কোনো কিছুর ক্ষেত্রে কিভাবে অসীমত্ব ধারণ করা সম্ভব?
আমরা যদি একই আর্গুমেন্ট এখানেও পেশ করি। ইউনিভার্স যদি ইনফাইনেট হয় তাহলে এর পৃর্বে অসীম সংখ্যক কারণ ঘটতে হবে যার ফলে ইউনিভার্স সৃষ্টি হবে বা বর্তমান সময়ে আসবে।
উপরে ইউনিভার্স অন্য কোনো সৃষ্ট বস্তু থেকে সৃষ্টি? এই টপিকে আমরা প্রমাণ করছি অসীম সংখ্যক কোনো কারণ ঘটলে বর্তমান সময়ে আসা সম্ভব না। সুতরাং ইউনিভার্স কখনোই অসীমত্ব ধারণ করতে পারেনা।