আমাদের জ্ঞানের উৎস কি কেবলই অভিজ্ঞতা? নাকি মন বা আত্মা ?

আমাদের জ্ঞানের উৎস কি কেবলই অভিজ্ঞতা?  নাকি মন বা আত্মা ? 


লিখেছেনঃ সাজ্জাতুল মাওলা শান্ত। 

জ্ঞানবিদ্যার একটি প্রধান সমস্যা হলো জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত সমস্যা। কারো কারো মতে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। আবার কারো কারো মতে বুদ্ধিই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। 
এই আর্টিকেলটি মূলত মুক্তমণা নাস্তিকদের উদ্দেশ্যে লেখা, যারা মনে করে জ্ঞানের একমাত্র উৎস হলো অভিজ্ঞাতা। কেননা মন বা আত্মা যদি জ্ঞানের উৎস হয় তাহলে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। তাই মুক্তমণা নাস্তিকদের অভিমত হলো জ্ঞানের উৎস কেবলই অভিজ্ঞতা। 

অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে জন্মের সময় মানুষের মন সাদা কাগজের ন্যায় থাকে। 
পরবর্তিতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কারণেই ব্যক্তির মনে বস্তু সম্পর্কে ধারণা আসে। যেমনটা বলেছেন  অভিজ্ঞতাবাদের জনক জন লক। কিন্তু সহজাত বা অন্তর ধারণা যদি না থাকে তাহলে কিভাবে একই পরিবেশে বেড়ে উঠার পরেও দুটি শিশু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টের অধিকারি হয় ? এই প্রশ্নের জবাব কি নাস্তিকরা দিতে পারবে?  
সহজাত ধারণার পক্ষে শুধু দার্শনিক যুক্তি আছে তাই নয়! এই ধারণার পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণও আছে।  
University of Oxford এর Centre for Anthropology and Mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin Berrett এ দীর্ঘ ১০ বছর শিশুদের উপর গবেষণা করে বলেছেনঃ 
"সাধারণত বাচ্চারা মনে মনে আগে থেকেই বিশ্বাস করে যে, একজন অতিপ্রাকৃত সত্তা কোনো একটি উদ্দেশ্যে এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছে। যদি কোনো দ্বীপে কিছু শিশুকে ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজেই বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়, দেখা যাবে তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে।" রেফারেন্সঃ http://www.telegraph.co.uk/news/religion/3512686/Children-are-born-believers-in-God-academic-claims.html 
তাহলে অভিজ্ঞতাবাদীরা যে দাবী করে জন্মের সময় মানুষের মন অলিখিত সাদা কাগজের মতো থাকে এটা মোটেও ঠিক নয়। 
ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাই যদি জ্ঞানের একমাত্র উৎস হয়ে থাকে তাহলে মানুষের মনের বিশ্লেষণী ক্ষমতা কি ভুল ? যে কোনো পর্যবেক্ষণকে বিশ্লেষণ করে তো আমরা নতুন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি! যেমনঃ শুধু মাত্র হত্যাকান্ডের স্থান পরিদর্শন করেই গোয়ান্দা কর্মকর্তারা অনেক রহস্য উন্মোচন করে ফেলতে পারে। এই রহস্যা উন্মেচন শধু মাত্র হত্যাকান্ডের স্থান পরিদর্শনের ফলে হচ্ছে না বরং; মানুষের মনের গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতাগুলোই এই সকল রহস্যা উন্মেচনে সহায়তা করে। 

আরেকজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউমের মতে

আমাদের সকল ইন্দ্রিয়জ ধারণা থেকে আসে। সংবেদন (সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বহির্জগতের বস্তু সম্পর্কে জানতে পারি) ছাড়া কোনো জ্ঞান হয়ন। তার মতে কোনো জ্ঞানই নিশ্চিত নয়। জন লকের মতেও জ্ঞানের প্রথম উৎস হলো সংবেদন ও অন্তদর্শন। সংবেদন ও অন্তদর্শনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা যায় তবে সব সময় সংবেদন গ্রহণের সময় কিভাবে মন নিষ্ক্রিয় থাকে তার ব্যক্ষ্যা কি নাস্তিকরা দিতে পারবে? 

মনোবিজ্ঞানের মতে মনের সক্রিয়তাই নিছক সংবেদন থেকে আমাদের মনে ধারণার সৃষ্টি করতে পারে। তাহলে ধারণা গ্রহনের সময় কিভাবে মন নিষ্ক্রিয় থাকে? 

অনেকে হয়তো বলবে Chemistry আমাদের মন মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করে। Chemistry আমাদের মন মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক তবে সেটা এরকম যে, আমরা হাত দিয়ে কি স্পর্শ করবো তা যেমন আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক করে দেই, তেমনি আমাদের মস্তিষ্ক কি নির্দেশ দিবে তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মন বা আত্মা। কেউ যদি বলে মন বা আত্মাকে অস্বীকার করা হয় তাহলে মস্তিষ্ক কেন আমাদের এই ধরণের নির্দেশ দেয় অন্য ধরণের দেয় না এই প্রশ্নের উত্তর কি হবে?  অর্থাৎ, Chemistry is the way to be joyful or sad, but not the cause.

এ টপিকে মোজাম্মেল হক স্যারের এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন। আর্টিকেল লিংকঃ 

একটা উদাহারণ দিচ্ছি, মনে করুন আপনি আলেপ খাবেন। আপনি যে খাবেন, তার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্বন্ধটা বিজ্ঞানি ও দার্শনিকেরা বের করতে পারবেন। আপনি যে ফল খাচ্ছেন সেটাও বের করতে পারবেন। ফলটা সুস্বাদু নাকি সুস্বাদু না সেটাও হয়তো বের করতে পারবেন। কিন্তু আপনি কেন আপেল খাবেন, আপনার কাছে সুস্বাদু  বা মিষ্টির মানে কি এগুলো আপনারা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। এগুলো কনোদিন বিজ্ঞান বের করতে পারবেনা। 


অভিজ্ঞতাবাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সরদার ফজলুল করিম স্যার লিখেছে, 

"এই নিছক অভিজ্ঞতাবাদের দূর্বলতা এই যে, এরুপ তত্ত্ব দ্বারা মানুষের মনের সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ,অনুমান প্রভৃতি জটিল ক্ষমতার ব্যখ্যাদান সম্ভব নয়। মানুষের মন ইন্দ্রিয়লদ্ধ অভিজ্ঞতাকে ভেঙ্গেচুরে তার জটিল যোগ-বিয়োগ দ্বারা বস্তুজগতের জ্ঞান তৈরি করে। মানুষের মনের এই ক্ষমতাকে স্বীকার করতে হয়, না হলে জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তূপে পর্যবসিত হয়।

রেফারেন্সঃ সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ-১৪৮পৃ. 


অভিজ্ঞতা কি আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে?

না। কেননা অভিজ্ঞতায় পাওয়া জ্ঞানকে সব সময় সন্দেহ করা যায়। যেমন, 'আকাশ নীল' না বলে 'হলুদ' বললে সেখানে চিন্তার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।  কিন্তু ২+২=৪, ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি দু'সমকোণ- এসব ধারণার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এগুলোর কোনো বিপরীত মত নেই। এগুলো সহজাত ধারণা। পৃথিবীর সমস্ত লোক ২+২=৬ বললেও ২+২= ৬ হবেনা ৪ হবে।  

অভিজ্ঞতাই কখনোই "অসীমের" ধারণা পাওয়া যায় না।      

অভিজ্ঞতার পূর্বে কখনো অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তু মনে উপস্থিত হতে পারেনা। যেমনঃ কেউ যদি "পাখি" না দেখে তাহলে তার মনে কখনোই পাখির ছবি জাগতে পারবেনা। কিন্তু আমাদের মনে কতগুলো সবসময় উপস্থিত থাকে। যেগুলোকে সহজাত ধারণা বলে।  

সহজাত ধারণার পক্ষে বৈজ্ঞানিক গবেষণা উপরে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কুরআনেও সহজাত ধারণার কথা উল্লেখ আছে।  

আল্লাহ'তালা বলেন,

তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানেনা। 

রেফারেন্সঃ সূরা আর-রুম; ৩০;৩০  

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ প্রত্যেক নবজাতকই ফিত্‌রাতের উপর জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা বা মাজূসী (অগ্নিপূজারী) রূপে গড়ে তোলে। যেমন, চতুষ্পদ পশু একটি পূর্নাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে কোন (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবূ হুরায়রা তিলাওয়াত করলেনঃ (فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ) (যার অর্থ) “আল্লাহর দেয়া ফিত্‌রাতের অনুসরণ কর, যে ফিত্‌রাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন”- (সূরা রুমঃ ৩০)। 

রেফারেন্সঃ সহীহ বুখারি; হাদিস নং- ১৩৫৯ 


Next Post Previous Post
2 Comments
  • israfil hossain
    israfil hossain ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ এ ২:২৬ AM

    সব ঠিক আ‌ছে ত‌বে ভি‌বিন্ন না বি‌ভিন্ন লিখ‌তে হ‌বে। আশা ক‌রি বিষয়‌টি ঠিক কর‌বেন।

    • Faith & Theology
      Faith & Theology ১১ ডিসেম্বর, ২০২১ এ ৮:৪৯ AM

      আসসালামু আলাইকুম। ধন্যবাদ।

Add Comment
comment url