বিজ্ঞান কি সত্য জানার একমাত্র মাধ্যম?

বিজ্ঞান  কি  সত্য  জানার একমাত্র  মাধ্যম?

বিজ্ঞান  কি?

বিজ্ঞান? কি এটা এমন কোনো বিষয় নয় যে, এই বিষয়ে সমস্ত বিজ্ঞানিরা মিলে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পেরেছে বা একমত হতে পেরেছে।

ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস লেডিম্যান এর মতে

❝We may not yet know how to define science or how to tell whether certain contentious activities or beliefs count as scientific or not, but we certainly have lots of example of Science ❞ “আমাদের সামনে বিজ্ঞানের অজস্র উদাহরণ থাকলেও বিজ্ঞানকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিংবা কোন ধরণের বিতর্কমূলক কার্যকম বা বিশ্বাস কে বৈজ্ঞানিক বলা হবে তা আমরা জানি না! রেফারেন্স

বিজ্ঞান কি? এই বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করে ফিলোসফি অব সায়েন্স। ফিলোসফি অব সাইন্সের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সায়েন্টিফিক মেথডোলজি। যারা এই বিষয়ে আলোচনা করে তাদেরকে ফিলোসফার অব সায়েন্স বলা হয়। ‘বিজ্ঞান কি?’, এ প্রশ্নের জবাবে তাদের অভিমত;

ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মিখেলা মাসিমির মতে;

❝Science just is what people who are professional scientists do.❞ অর্থাৎ, বিজ্ঞান হল ওটাই যা পেশাদার বিজ্ঞানীরা চর্চা করেন। কিন্তু এ সংজ্ঞাটি খুব একটা কার্যকরী নয়। রেফারেন্স

ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্লার্ক লারসেনের মতে,

❝Science is way of knowing, it’s a learning process, and it connects our lives with our world.❞ অর্থাৎ, বিজ্ঞান হল জানার এবং শেখার প্রক্রিয়া! এটি আমাদের লিভিং বিয়িং এর সাথে নন-লিভিং ওয়ার্ল্ডের সংযোগ ঘটায়।রেফারেন্স

নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ম্যানুয়েল মোলস এর মতে

❝Broadly speaking, science is a way of obtaining knowledge about the natural world using certain formal procedures.❞ অর্থাৎ,ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞান হল কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। রেফারেন্সঃ

বিজ্ঞানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার সম্পর্কে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন,

❝Science is a way of knowing about the natural world. It is limited to explaining the natural world through natural causes. Science can say nothing about the supernatural. Whether God exists or not is a question about which science is neutral.❞ অর্থাৎ, “বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছেন নাকি নেই- এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ।”রেফারেন্স

বিজ্ঞান  কিভাবে  কাজ  করে ? 

ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, এবং তার গবেষণা এবং সে ফলাফল বিজ্ঞান।
অর্থাৎ,যা ভৌত নয়, পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ যোগ্য নয় তা নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। যেমন, আমাদের মানব দেহ একটা ভৌতবস্তু। তাই বিজ্ঞান মানব দেহ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু আমাদের দেহের সৌন্দর্য ভৌতবস্তু নয়। তাই বিজ্ঞান সৌন্দর্য্য নিয়ে আলোচনা করেনা। সৌন্দর্য বিষয়ে আলোচনা করার জন্য “নন্দনতত্ত্ব”(Aesthetic) নামে আলাদা একটা শাস্ত্র রয়েছে। একইভাবে আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। এসব বিষয়ে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স আলোচনা করে। ।

বিজ্ঞান কোনো কিছুকে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করে হাইপোথেসিস উপস্থাপন করবে এবং সেই হাইপোথেসিসকে ধাপে ধাপে পরিক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে একটি থিওরি বা তত্ত্ব উপস্থাপন করে। তত্ত্বকে চাইলেই যেকোনো সময় পরীক্ষা করা যাবে, যাচাই করা যাবে।


থিওরি হচ্ছে বিজ্ঞানের নির্ভুলতার সর্বোচ্চ স্তর। থিওরি বলতে আমরা সাধারণত বুঝতে পারি থিওরি কেবলই একটা ধারণা বা কল্পনা। কিন্তু বৈজ্ঞানিক থিওরি বলতে আসলে তা বোঝায় না। তবে বৈজ্ঞানি থিওরি যতই শক্তিশালী হোক না কেন থিওরি কখনো absolutely truth বা বাস্তব সত্য নয়। বিজ্ঞান কখনোই আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনা।

বিজ্ঞান কি নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে ?

ভৌত বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা দিতে পারবেনা। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের কখনোই নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারেনা।

Stanford Encyclopedia of Philosophy তে বলা হয়ছে,

“বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে একটু লক্ষ করলে একসময়ে প্রভাবশালী ও গ্রহণযোগ্য এমন অনেক তত্ত্ব চোখে পড়বে, যেগুলো আজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে পড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ সেগুলো আর গ্রহণযোগ্য নয়। রেফারেন্স

দার্শনিক কার্ল পেপার বলেন,

“বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সৃষ্টি হয় সত্যের সন্ধান করতে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি কোনো নিশ্চয়তার সন্ধান নয়। মানুষের সকল জ্ঞান ভুলপ্রবণ, তাই অনিশ্চিত। রেফারেন্স

মনোবিজ্ঞানি কিথ স্ট্যানোভিচ বলেন, বিজ্ঞান ইতঃপূর্বে যা সত্য বলে প্রমাণ করেছিল, তাকেই প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রমাণ করে চলেছে। রেফারেন্স

উদাহারণ হিসেবে আমরা নিউটনের তত্ত্বকে ধরে নিতে পারি। নিউটনের তত্ত্ব বিজ্ঞান মহলে পুরো দুইশত বছর টিকে ছিল। এই দুইশত বছর বিজ্ঞান পূজারি থেকে সাধারণ মানুষও এই তত্ত্বকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটনের তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।

বৈজ্ঞানিক থিওরি দুটো কারণে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনা।

1. The problem of induction 2. Scatter graph problem

The problem of induction

The problem of induction অনেকটা এরকম যে, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক থিওরিও পরিবর্তন হবে। যেমন; ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মনে করা হতো, পৃথিবীর সকল হাস সাদা। কেননা ততদিন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষনলদ্ধ সকল হাস ছিলো সাদা রঙ’এর। কিন্তু ১৬৯৭ সালে উইলিয়াম দ্যা ব্লামিং অস্ট্রেলিয়াতে কালো রাজ হাস আবিষ্কার করেন। এতে করে (All swans are white and have always been white) এই তত্ত্বটি ভুল প্রমাণ হয়ে যায়। সুতরাং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যত বাড়বে তত বৈজ্ঞানিক থিওরী পরিবর্তন হবে। এটাই হলো problem of induction.

Scatter graph problem

Scatter graph problem হচ্ছে, একই পর্যবেক্ষণ থেকে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমন; আমাদের কাছে ১০০টি বিন্দু রয়েছে। এগুলো হলো তথ্য। আমাদেরকে যদি এই তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বলা হয় তাহলে দেখা যাবে, কেউ এগুলো দিয়ে একটা সরলরেখা তৌরি করেছে। কেউ বক্ররেখা তৌরি করেছে। কেউ ত্রিভূজ, চতুভূজ, বর্গক্ষেত্র তৌরি করেছে। অর্থাৎ, একই পর্যবেক্ষণ ও তথ্য অনেকগুলো তত্ত্বের সম্ভাবনা রাখে। সম্ভাব্য তত্ত্বগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হওয়ার ফলে বৈজ্ঞানিক থিওরিও প্রতিনিয় পরিবর্তন হয়। যার ফলে থিওরি কখনোই আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা। এটাই হচ্ছে Scatter graph problem.

প্রখ্যাত পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন নিউ ইয়র্ক রিভিউতে এক আর্টিকেলে লিখেন,

❝The public has a distorted view of science, because children are taught in school that science is a collection of firmly established truths. In fact, science is not a collection of truths. It is a continuing exploration of mysteries❞ অর্থাৎ, “বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষজনের একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে শেখানো হয় যে, বিজ্ঞান হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের সমাহার! আসলে বিজ্ঞান কোন ‘কালেকশন অব ট্রুথ’ নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে ক্রমাগত রহস্যোন্মোচন।”“Science is not a collection of Truths” রেফারেন্সঃ

বিজ্ঞান কি সৃষ্টিকর্তা বা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ে আলোচনা করে?

ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তা নিয়েই বিজ্ঞান আলোচনা করে। আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। কেননা এগুলো পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য নয়। এসব বিষয়ে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স আলোচনা করে। ।

ডার্ক এনার্জির ধারণা আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরুষ্কার পাওয়া টিমের একজন সদস্য Alex Filippenko, RT নিউজের সাক্ষাৎকারে বলেন,

“আমি মহাবিশ্বকে একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতে চাই। কোনো অতিমানবিক বা স্বকীয় স্রষ্টা আছে কি না বা এই মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবোনা। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনা।” রেফারেন্সঃ

এই টপিকে অন্যান্য আর্টিকেলঃ

আমাদের জ্ঞানের উৎস কি কেবলই অভিজ্ঞতা? নাকি মন বা আত্মা ? – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url